সারা দেশে পাখির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। গণনা করে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব পাখির যে মোট সংখ্যা পেয়েছে, তা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। গত বছরের তুলনায় এবার দেশে পাখির বিচরণ কমেছে প্রায় ৪০ হাজার।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএনের সঙ্গে যৌথভাবে করা ওই জরিপে দেখা গেছে, বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকা ও সোনাদিয়া দ্বীপে পাখির বিচরণ আগের বছরের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছ। গত ছয় বছরের মধ্যে এ বছর সবচেয়ে কম পাখি বিচরণ করতে দেখেছে সংগঠনটির জরিপকর্মীরা।
১৯৯৪ সালে দেশের সর্বপ্রথম পাখি জরিপে পাখি পাওয়া গিয়েছিল প্রায় ৮ লাখ। ২০১৭ সালে পাখি দেখা গেছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৩২টি, যা ২০১৮ সালে নেমে এসেছে ১ লাখ ৬৩ হাজার ২১টিতে। বার্ড ক্লাবের সদস্য ও দেশের পাখি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন এবং পাখিদের বিচরণ এলাকায় মানুষের নানা তৎপরতার কারণে পাখিরা অন্যত্র চলে যাচ্ছে। এর আগেও নানা কারণে পাখিরা স্থান বদল করেছে। তাই এক জায়গায় পাখি কমলে অন্য জায়গায় তাদের বেশি পরিমাণে পাওয়া গেছে। কিন্তু এবার পাখিরা বিকল্প জায়গাতেও সুবিধা করতে পারছে না। এর ফলে সব মিলিয়ে পাখির পরিমাণ কমতে দেখা গেছে।
কেন কমছে
দেশের বেশির ভাগ পাখি জলাভূমি ও কাদামাটির চরগুলোতে বিচরণ করে। গাছে বসবাস করে অনেক পাখি। দেশের হাওর, নদী ও উপকূলীয় চরগুলোসহ পাখির বসবাস ও বিচরণের ক্ষেত্রগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যেমন হাওরগুলোতে ধান চাষ করতে গিয়ে পানি শুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। সার দেওয়ার ফলে পাখির খাবার পোকামাকড় মারা যাচ্ছে। চরগুলোতে মানুষের বসতি বেড়ে যাওয়ায় তাতে পাখি আসা কমিয়ে দিয়েছে। আর নদীগুলোতে দূষণ বেড়ে যাওয়ায় পাখি সেখানে থাকতে পারছে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক প্রথম আলোকে বলেন, দেশে যেসব পাখি দেখা যায় তার বেশির ভাগই পরিযায়ী। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত বিশ্বের ২০টি দেশে তারা বিভিন্ন ঋতুতে যায়, থাকে। যে দেশে তাদের বসবাসের অনুকূল পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে, সেই দেশ থেকে তারা অন্য দেশে চলে যাবে। বাংলাদেশে ৩৪ বছর ধরে পাখি জরিপের তথ্য উল্লেখ করে এই পাখি বিশেষজ্ঞ বলেন, দেশে পাখির সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমছে, যা দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য ও বৈশিষ্ট্য নষ্ট হওয়ার ইঙ্গিত করে।
কোথায় কোন শুমারিতে কী পাওয়া গেল
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্যরা চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুই মাসের বিভিন্ন সময়ে পাখি বেশি থাকে দেশের এমন পাঁচটি এলাকায় শুমারিটি করেছেন। ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিবছর একই সময়ে তাঁরা জরিপটি করে থাকেন। এ বছর দেশের উপকূলীয় এলাকার ভোলা ও নোয়াখালীর চর সোনাদিয়া দ্বীপ, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, সিলেট ও মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর ও বাইক্কার বিলে জরিপটি করা হয়। শীতের এই সময়টাতে ওই এলাকাগুলোতে পাখি বেশি থাকে বলে জরিপটি করা হয়।
শুমারির ফলাফল অনুযায়ী টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখির সংখ্যা গত এক বছরে ৯১ হাজার ২৩৬টি থেকে কমে ৫৯ হাজার ৫৪২টিতে নেমে এসেছে। হাকালুকিতে ৫৮ হাজার ২৮৯টি থেকে কমে ৪৫ হাজার ১০০টি, বাইক্কার বিলে ১০ হাজার ৭৩৬টি থেকে কমে ১০ হাজার ২৫৪টি এবং উপকূলে ৪১ হাজার ৪৫টি থেকে কমে ২৬ হাজার ৫২৫টি হয়েছে। তবে সোনাদিয়ার পাখির সংখ্যা অপরিবর্তিত আছে।
এ ব্যাপারে বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের উপকূলীয় চরগুলোতে কৃষি কাজে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। কাদামাটির চরগুলো শক্ত হয়ে যাচ্ছে, গাছ কেটে নানা ধরনের উন্নয়নকাজ হচ্ছে। উপকূলের কিছু চরকে পাখিদের বসবাসের জন্য ছেড়ে না দিলে একদিন হয়তো আমরা দেখব উপকূলে আর কোনো পাখি নেই। আর পাখি না থাকলে দেশের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে।